ব্রেইনের রক্ত সরবরাহ কোন কারনে বিঘ্নিত হলে রক্তের অভাবে কিছু ব্রেইন টিস্যু মারা যায়, এটাই হল স্ট্রোক । বিশেষ করে রক্ত নালী ব্লক হয়ে কিংবা রক্তনালী ছিঁড়ে ব্রেইনের এই রক্ত সরবরাহ বিঘ্ন হয় । প্রতি ৬ জনে ১ জন স্ট্রোক করে । স্ট্রোকের জন্য অনেক ব্যয়বহুল এবং পুরোপুরি সম্ভব হয় । স্ট্রোক মৃত্যুর সারাবিশ্বে দ্বিতীয় । তাই স্ট্রোকের চিকিৎসার চেয়ে স্ট্রোক প্রতিরোধ সহজ এবং উত্তম উপায় ।
স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায় বা স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় কি
স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে হলে, আগে আমাদের জানতে হবে স্ট্রোক কেন হয়, স্ট্রোকের রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো কি কি?
অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো থাকলেই মূলত স্ট্রোক হওয়ার সম্ভবনা অনেক অনেক বেড়ে যায় । এই রিস্ক প্রক্টর গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় –
A) কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারি নাঃ
• বয়স বাড়ার সাথে স্ট্রোক ঝুকি বাড়তে থাকে । সাধারনত ৫৫ বছর পর স্ট্রোক ঝুকি অনেক বেড়ে যায় । তবে স্ট্রোক যেকোন বয়সেই হতে পারে। বাচ্চাদেরও স্ট্রোক হয়। বিশেষ করে যেইসব বাচ্চার জন্মগত হার্ট ডিজিজ থাকে তাদের ১৯ গুন বেশি স্ট্রোক ঝুকি থাকে ।
• যুবতীদের তুলনায় যুবকরা স্ট্রোক বেশি করে ।তবে স্ট্রোকে বেশি মারা যায় মহিলারা, কারণ মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে , ফলে তারা বেশি বয়সে স্ট্রোক করে বেশি ।
B) মডিফাইএবল (নিয়ন্ত্রনযোগ্য) রিস্ক ফ্যাক্টর / স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়সমূহঃ
অধিকাংশ রিস্ক ফ্যাক্টরকেই আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারি এদের কে মডিফাইএবল বা নিয়ন্ত্রনযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টর বলা হয়ে থাকে । ৯০% স্ট্রোকের জন্যই এই মডিফাইএবল রিস্ক ফ্যাক্টর দায়ী ।
I. মেডিকেল কন্ডিশন সম্পৃক্ত রিস্ক ফ্যাক্টর ঃ
১। উচ্চরক্তচাপঃ
উচ্চরক্ত চাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় রিস্ক ফ্যাক্টর । উচ্চরক্তচাপের কারনে রক্তনালীর পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে স্ট্রোক হয়ে থাকে ।
রক্তচাপ হল রক্তনালীতে রক্তের প্রেশার বা চাপ । শরীরে রক্ত পাম্প করা সময় রক্ত কতটা জোরে রক্তনালির ওয়ালে বা পর্দায় চাপ দিচ্ছে সেটাই হল উচ্চরক্তচাপ । রক্ত হার্ট থেকে বের হওয়ার সময় রক্তনালীর দেওয়ালে যে চাপ দেয় সেটা হল সিস্টোলিক প্রেশার (বেশি প্রেশার ) এবং দুইটা চাপের মাঝ খানে যে প্রেশার পাওয়া যায় সেটা হল ডায়াস্টোলিক । স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ , এখানে ১২০ (বেশি টা ) হল সিস্টোলিক প্রেশার এবং ৮০ ( কম টা) হল ডায়াস্টোলিক প্রেশার , আর দুইটা মিলেই রক্তচাপ হিসেব হয় । সাধারনত ১৪০/৯০ বা এর বেশি হলে উচ্চরক্তচাপ হিসেবে গন্য করা হয়।
তবে দুঃখের বিষয় হল, স্ট্রোকের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা বুঝতেই পারি না আমাদের উচ্চরক্তচাপ ছিল । সাধারনত হঠাৎ করে মাথা ঘোরা, নিশ্বাস নিতে কষ্ঠ হওয়া , মাথা ব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখা এইসব উচ্চরক্তচাপের লক্ষন । তবে অনেক সময়, কোন লক্ষনই বুঝা যায় না । বিপি মেশিনে চেক করলে উচ্চরক্তচাপ পাওয়া যায় । নিরবঘাতক এই উচ্চরক্তচাপ চিকিৎসা বিহীন থাকলে স্ট্রোক, হার্ট এটার্ক , কিডনি ডেমেজ সহ অনেক বড় সমস্যা হয়ে থাকে ।
নিয়মিত রক্তচাপ চেক আপ করুন । উচ্চ রক্তচাপ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মত নিয়মিত ওষুধ খাবেন এবং ফিজিওথেরাপিস্টেরর পরামর্শ মত নিয়মিত এক্সারসাইজ করবেন । স্ট্রোক ঝুকি থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।
২। ডায়বেটিসঃ
ডায়বেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোক ঝুকি প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি যার ডায়বেটিস নেই তার চেয়ে ।
ডায়বেটিস কিভাবে স্ট্রোক ঝুকি বাড়ায়?
আমরা খাবারের সাথে যেই পরিমান সুগার (মিষ্টি) খাই , সেটাকে ভাঙ্গার জন্য এক ধরনের হরমোন লাগে যেটাকে ইনসুলিন বলা হয় । টাইপ ১ ডায়বেটিস থাকলে , শরীর সেই ইনসুলিন টা তৈরি করতে পারে না । টাইপ ২ ডায়বেটিস থাকলে, সেই ইনসুলিন শরীরে তৈরি হয়, তবে পরিমানে যথেষ্ট না ।
এইভাবে সুগারের পরিমান বাড়তে থাকলে রক্তনালীতে এথেরোস্কেলেরোসিস (রক্তনালীর ভিতরে ফ্যাট, কোলেস্টেরল জমে) বৃদ্ধি পায় । এর ফলে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে উচ্চরক্তচাপের কারনে স্ট্রোক ঝুকি বেড়ে যায় ।
তাই ডায়বেটিস থাকলে অবশ্যই ডায়বেটিস চিকিৎসকের দেখিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা নিবেন এবং ফিজিওথেরপিস্টের পরামর্শ মত নিয়মিত ব্যায়াম করবেন ।
৩। এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন (Atrial fibrillation- Irregular pulse)ঃ
এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন হল এক ধরনের অনিয়মিত হার্টবিট, সাধারনত দ্রুত হার্টবিট দেয় । অনিয়মিত হার্ট বিটের কারনে অনেক সময় রক্ত জমাট বেধে ছোট চাকা হয়ে যায়, যেটা রক্ত নালী দিয়ে ব্রেইনে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে রক্তনালী ব্লক করে স্ট্রোক ঘটায় । এট্রিয়াল ফিব্রিলেশন স্ট্রোক ঝুঁকিকে ৫গুন বাড়িয়ে দেয় । এতবড় স্ট্রোক ঝুকি, তবে দুঃখের বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা ডায়াগনোসিস হয় না কিংবা চিকিৎসা বিহীন থেকে যায় । তাই কারও অনিয়মিত পালস থাকলে অবশ্যই আপনার ফিজিশিয়ান বা বিশেষজ্ঞ ফিজিশিয়ান (কার্ডিওলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ) দেখাবেন । যাদের বয়স ৫৫ এর বেশি এবং সাথে হার্ট ডিজিজ বা থাইরয়েড ডিজিজ আছে তাদের ক্ষেত্রে এট্রিরিয়াল ফিব্রিলেশন কমন ব্যাপার ।
৪। উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলঃ
শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য কোলেস্টেরল দরকার । কিন্তু বেশি কোলেস্টেরল হলে রক্তনালীতে জমা হয়ে যায় , যেটা রক্তনালী সংকুচিত করে স্ট্রোক ঝুকি বাড়িয়ে দেয় । তাই নিয়মিত স্বাস্থ্যমত খাবার খাবেন এবং নিয়মিত ব্যায়াম করবেন । অতিরিক্ত ওজন হলে ডায়বেটিস দেখিয়ে খাবার খাবেন এবং ফিজিওথেরাপিস্ট দেখিয়ে ব্যায়াম করবেন ।
৫। সিকল সেল ডিজিজঃ
এই ধরনের ডিজিজে সাধারণত রেড ব্লাড সেল গোল আকৃতি থেকে চন্দ্রাকৃতি হয়ে যায়, যেটা রক্ত নালীতে রক্ত সরবরাহ আটকে দেয় এবং স্ট্রোক ঝুকি বাড়িয়ে দেয় ।
II. লাইফস্টাইল গত রিস্ক ফ্যাক্টর ঃ এই রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো আমরা আমাদের অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রন করতে পারি –
১। অ্যালকোহল ঃ অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান স্ট্রোক ঝুকি বাড়িয়ে দেয় ।
২। ধূমপানঃ ধূমপান স্ট্রোক ঝুকিকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয় । তাই ধূমপান পরিহার করুন স্ট্রোক থেকে নি জেকে রক্ষা করুন ।
৩। বিভিন্ন ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য যেমন কোকেইন স্ট্রোক ঝুকিকে অনেক বাড়িয়ে দেয় । নেশাজাতীয় ড্রাগস পরিহার করুন , স্ট্রোক থেকে নিজেকে রক্ষা করুন ।
৪। শারিরীক প্ররিশ্রমের অভাবঃ বিশেষ করে যারা শারিরীক প্ররিশ্রম যারা কম করেন বা অলস জীবন যাপন করে, স্ট্রোক হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি ।
৯০% স্ট্রোক প্রতিরোধ যোগ্য-
চিকিৎসা বিষরক মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট ২০১৬ সালে স্ট্রোক নিয়ে আন্তজার্তিকভাবে অনেক বড় একটি গবেষনা প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে ১০ টা মডিফাইএবল ( নিয়ন্ত্রন যোগ্য) রিস্ক ফ্যাক্টর ৯০% স্ট্রোকের জন্য দায়ী । যেখানে উচ্চরক্তচাপকে সবচেয়ে রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে দেখানো হয়েছে । প্রকৃত পক্ষে স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে শর্টকার্ট উপায় নেই , রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো পরিহার করা , নিয়মিত এক্সারসাইজ এবং সঠিক খাবারের মাধ্যমে স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব ।
রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো এবং তারা কে কত পার্সেন্ট দায়ী স্ট্রোকের জন্য নিম্নে দেওয়া হল –
১। উচ্চরক্তচাপ = ৪৮%
২। শারিরীক প্ররিশ্রমের না করা = ৩৬%
৩। অস্বাভাবিকমাত্রার কোলেস্টেরল লেভেল = ২৭%
৪। অস্বাস্থ্যকর খাবার = ২৩%
৫। অতিরিক্ত ওজন = ১৯%
৬। অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং হতাশা = ১৭%
৭। ধূমপান = ১২%
৮। হার্ট ডিজিজ = ৯%
৯। অ্যালকোহল = ৬%
১০। ডায়বেটিস = ৪%
ধন্যবাদ
প্রতিষ্ঠাতা , বাংলাদেশ স্ট্রোক ফাউন্ডেশন ।
Consultant Physiotherapist
BPT (DU), MPT (Ortho)
PGC in Acupuncture (India)
Specially Trained in Ozone Therapy