সেরিব্রাল পালসি কি ভালো হয় ? হ্যাঁ ভাল হয় , সঠিকভাবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে সেরিব্রাল পালসি অনেকটাই ভাল হয় । সেরিব্রাল পালসি কি , সেরিব্রাল পালসি কেন হয় , সেরিব্রাল পালসি এর লক্ষণ এবং এর আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে এই লেখা –
দীর্ঘদিন আকাঙ্খার পর সেলিম মিয়ার ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসলো এক আলো। পুরো পরিবার আনন্দে আত্মহারা। সবাই বাচ্চার নাম রাখতে এবং মিষ্টি খেতে তাড়াহুড়া শুরু করল। হায় হায় কিছুদিন পর সেলিম মিয়া দেখল তার হিরার টুকরা সন্তান অন্যসব সন্তানদের মত হাসে না, খেলাধুলা করে না, নড়াচড়া করে না এবং পেশিগুলো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে সুখের পরিবারে চিন্তার শেষ নেই। কি হলো আমার এ হিরার?
হ্যা সেলিম মিয়ার বাচ্চার সেরিব্রাল পালসি হয়েছে। চলুন আজকে জেনে নেই সেরিব্রাল পালসি কি, কেনো হয়?এর চিকিৎসা কি? আর সেরিব্রাল পালসি কি ভালো হয়?
সেরিব্রাল পালসি কি?
সেরিব্রাল পালসি সবচেয়ে পরিচিত অ-উন্নীত মটর সমস্যা।যেখানে বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিকমত হয় না। সেরিব্রাল মানে হলো মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত । আর পালসি হলো পেশিগুলোর দূর্বলতা নির্দেশ করে। যেখানে একজন বাচ্চার দেহের ভারসাম্য,নড়াচড়া এবং দেহের অঙ্গবিন্যাসে সমস্যা দেখা দেয়।
এছাড়াও সেরিব্রাল পালসিতে যোগাযোগ , চেনা এবং মাস্কুলোস্কেলেটাল সমস্যা দেখা দিতে পারে। সহজ কথায় সেরিব্রাল পালসিতে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতায় সমস্যা হয়। আর আমরা জানি মস্তিষ্ক হলো আমাদের দেহের নিয়ন্ত্রক । মস্তিষ্কের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট দেহের কোন অঙ্গের ভারসাম্য, অঙ্গবিন্যাস সমস্যা হয়ে থাকে।
সেরিব্রাল পালসির কারণ কি / সেরিব্রাল পালসি কেন হয় :
প্রি-নেটাল:( বাচ্চা জন্মের আগে মায়ের/প্লাসেন্টার/ ফিটাল)
- আয়রন ডিফেসেয়েন্সি এবং অপুষ্টি।
- ইউটেরিয়ান ইনফেকশন, জ্বর।
- মাতৃতান্ত্রিক রোগ: যেমন ডায়বেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপার-থাইরডিজম।
- বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, ধুমপান, অ্যালকোহল, মদ্যপান।
- অনেক বেশি বয়সে বাচ্চা ধারন করলে।
পেরিনেটাল : (বাচ্চা জন্মের সময়)
- বাচ্চা সময়ের আগে জন্ম নিলে।
- জন্মগত অ্যাসপেশিয়া।
- ইউটেরাস এর মধ্যে বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমত না হলে।
- সেপসিস, এটা গ্রাম অঞ্চলের মানুষদের বেশি দেখা যায়।।
- হাইপোগ্লাইসেমিয়া।
- আর্থ সামাজিক অবস্থা ভালো না থাকলে।
পোস্ট-নেটাল:(বাচ্চা জন্মের পর)
- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ইনফেকশন যেমন এনসেফালোপ্যাথি, টিউবারকুলার মেনিনজাইটিস।
- মাথার সমস্যা
- সিজার
- জেনেটিক কারণে হতে পারে
সেরিব্রাল পালসি কত প্রকার
সেরিব্রাল পালসিকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়।যথা:
- স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পালসি: স্পাস্টিক সেরিব্রাল পালসিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
১) স্পাস্টিক ডিপ্লেজিয়া – পায়ের পেশী শক্ত হয়ে যায়
২) স্পাস্টিক হেমিপ্লেজিয়া – শরীরের অর্ধেক পার্টকে প্রভাবিত করে
৩)স্পাস্টিক কোয়াড্রিপ্লেজিয়া – দুই হাত এবং দুই পা কে প্রভাবিত করে
- ডিস্কাইনেটিক সেরিব্রাল পালসি : এই সেরিব্রাল পালসিতে নড়াচড়াতে সমস্যা হয়ে থাকে। ডিস্কাইনেটিক সেরিব্রাল পালসিকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
১) ডাইস্টোনিক – পেশীর দৃঢ়তা অস্বাভাবিক নয়।
২) অ্যাথেটোয়েড – বাকাভাবে নড়াচড়া করবে।
৩)কোরিওথেটোয়েড – অস্বাভাবিক নড়াচড়া করবে।
- অ্যাটাক্সিক সেরিব্রাল পালসি: এটা একটি ভারসাম্য জনিত সমস্যা। মস্তিষ্কের সেরেবেলাম এর সমস্যার কারণে এধরনের সেরিব্রাল পালসি হয়ে থাকে।
- মিশ্র সেরিব্রাল পালসি: এধরনের সেরিব্রাল পালসিতে বিভিন্ন ধরনের সেরিব্রাল পালসি একত্রিত হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মিশ্র সেরিব্রাল পালসি হল স্পাস্টিক এবং ডিস্কাইনেটিক সেরিব্রাল পালসির সংমিশ্রণ।
সেরিব্রাল পালসির লক্ষণ/সেরিব্রাল পালসি বৈশিষ্ট্য
- পেশিগুলো শক্ত হয়ে যায়।
- ভারসাম্য এবং সমন্বয়হীনতা ভূগবে।
- আস্তে আস্তে লিখবে।
- ঝাকুনি থাকবে।
- স্বাভাবিকভাবে হাটতে অসুবিধা হবে।
- শার্টের বোতাম লাগোতে সমস্যা হবে।
- কথা বলতে অসুবিধা হবে।
- খাদ্যে চিবাতে অসুবিধা হবে।
- মটর স্কিল ডেভেলপমেন্টে অসুবিধা হবে।
- অস্বাভাবিক ব্যথা থাকবে।
- কানে শুনতে অসুবিধা হবে।
- অস্বাভাবিক চোখের সমস্যা হবে।
- মানসিক সমস্যা থাকবে।
সেরিব্রাল পালসি চিকিৎসা
ডায়াগনোসিস/কেমনে বুঝবো সেরিব্রাল পালসি হয়েছে?
সাধারণত জন্মের ১-২ বছরের মধ্যে সেরিব্রাল পালসি বুঝা যায়। তবে তিনটি মাধ্যমে আমরা সহজেই সেরিব্রাল পালসি চিহ্ণিত করতে পারি।
১) বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট পর্যবেক্ষণ : আপনার বাচ্চা অন্যসব বাচ্চার মত খেলাধূলা করছে কিনা? হাসি-খুশি থাকছে কিনা? বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে কিনা? এই বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।
২) বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট বিচার বিশ্লেষন : বাচ্চার বৃদ্ধি কত দিন থেকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে ? তারপর বাচ্চা ১৮ মাস বয়স থেকে হাটতে পারছে কি? বাচ্চার এসব অস্বাভাবিক আচরনগুলো কতদিন যাবৎ হচ্ছে,কেন হচ্ছে এগুলো বিশ্লেষন করে চিকিৎসক ট্রিটমেন্ট প্লান করবেন।
৩) মেডিক্যাল কিছু পরীক্ষা করার মাধ্যমে:
- এক্সরে
- এমআরআই
- সিটিস্ক্যান
সেরিব্রাল পালসিতে কোন চিকিৎসকের কাছে যাবো?
সেরিব্রাল পালসির জন্য মাল্টিডিসপ্লেনারি টিমের প্রয়োজন হয়। যেখানে থাকবে:
- নিউরোলজিস্ট
- ফিজিওথেরাপিস্ট
- অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
- স্পীচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট
- অর্থোপেডিশিয়ান
- পেডিয়েট্রিশিয়ান
- নিউট্রেশিয়ান
- ফ্যামিলি ট্রেইনার
সেরিব্রাল পালসির চিকিৎসা?
ঔষধ: মাংসপেশির দৃঢ়তা, ব্যথা , পেশি থলথলে হয়ে যাওয়ার কিছু ঔষধ খাওয়া যেতে পারে।
ইনজেকশন: অনেক সময় কিছু চিকিৎসক তার নার্ভ ,পেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য ইনজেকশন সাজেস্ট করেন। যদিও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাই ইনজেকশন না নেওয়াই ভালো।
রিহ্যাব চিকিৎসা:
- নিউরোডেভেলপমেন্ট ট্রেইনিং
- মটর ফেসিলিয়েশন অ্যাপ্রোচ
- খাবার খাওয়ার জন্য পুনর্বাসন
- কথা বলার পুনর্বাসন
- কানে শুনার জন্য পুনর্বাসন চিকিৎসা
- চোখে দেখার পুনর্বাসন চিকিৎসা
- চেস্ট এর পুনর্বাসন চিকিৎসা
- দৈনন্দিন কাজের পুনর্বাসন
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা:
সেরিব্রাল পালসি রোগীদের যত দ্রুত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া যায় তত ভালো। কারণ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমেই একজন সেরিব্রাল পালসির রোগীকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
পর্যালোচনা:
সেরিব্রাল পালসি কি ভালো হয় ?
উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা এটিই বুঝতে পারি যে, সেরিব্রাল পালসি হলো যে একটি নন প্রোগ্রেসিভ ডিজিজ। সহজ কথায় এটা যেমন আছে ঠিক ওইরকমই থাকে। তবে ফিজিওথেরাপি চিকিসার মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজকর্মগুলো যাতে করতে পারে সেই দিক গুলো খেয়াল করা হয়। তাই আমরা বলতে পারি, সেরিব্রাল পালসি আদৌ ভালো হয় না। তবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিলে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবে।
আরো এরকম লেখা পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
ধন্যবাদ
বিপিটি ( ঢাবি ) ,
এমপিটি ( অর্থোপেডিকস ) – এন.আই.পি.এস , ইন্ডিয়া
পিজি.সি. ইন আকুপাংচার , ইন্ডিয়া
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ওজন থেরাপি , ইউ.এস.এ এবং ওজোন ফোরাম , ইন্ডিয়া ।
ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট , ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার ।
পরামর্শ পেতে – ০১৭১০-৮৫০৫৬৩ , ০১৯৩২৭৯৭২২৯
এপয়েন্টম্যান্ট নিতে ক্লিক করুন
Consultant Physiotherapist
BPT (DU), MPT (Ortho)
PGC in Acupuncture (India)
Specially Trained in Ozone Therapy